ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয় সফল ও বিজয়ীদের। পৃথিবীতে ব্যর্থ ও পরাজিতদের ইতিহাস থাকে না। চব্বিশের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের বর্তমানে বীর সম্ভোধন করছি। যদি আন্দোলনে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন না হতো, তবে আজকের বীরেরা নাশকতার মামলায় জেলে পুড়তো। আমরা যা ৫ আগস্টের পূর্বে ছাত্রদেরকে ব্লকরেইড দিয়ে গ্রেপ্তারের সময় দেখেছি। সুতরাং, বলা যায়- জয় বা পরাজয়ের ভিত্তিতে সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিহাস ভিন্ন ভাবে রচিত হয়।

তৃতীয় নয়নে দেখা
আমরা কথায় কথায় নেতৃত্বের ব্যর্থতার গল্প নিয়ে হাজির হই। তারা এটা করেনি, ওটা পারে নি, ওইটা ছাড়েনি। দালালি করেছে, কেউ চিনে না, সংলাপে সবাই যায়- স্বৈরাচারের দালালি করেছে তাই ডাকে না, টাকা দিয়ে বিক্রি হয়েছে, দল ধ্বংস করেছে, পদ ছাড়ছে না, ওনারা পারবে না, ব্লা.. ব্লা. ব্লা।
উপর্যুক্ত বিষয়ে আলোচনার পূর্বে একটি ঘটনার আলোকপাত করছি।২০২৩ সালের লাস্টের দিকে আমাদের কোর্ট চেম্বারে ওলামালীগের একজন কেন্দ্রীয় ও চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান নেতা এসেছিলেন। ছাত্রসেনার সাবেক সভাপতি জি.এম শাহাদত হোসাইন মানিক ভাই তার পরিচয় আমাকে বলার সাথে সাথে আমি বললাম, আস্তাগফিরুল্লাহ। ওই লোকের সাথে নূন্যতম সৌজন্যতা দেখাতে আমার ঘৃণা লাগছিল। ফলে আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। তখন আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে, আলেম ব্যক্তি ইসলামী যে কোন দল করবে, এটাই স্বাভাবিক। আলেম ব্যক্তি কখনও ইসলাম বিরোধী /ধর্ম নিরপেক্ষতা মতবাদ সমর্থন বা গ্রহণ বা লালন করতে পারেন না। দুঃখজনক হলেও নির্মম সত্য যে, বিগত ১২/১৪ বছরে সুন্নী আলেমরা শাসকগোষ্ঠির এত মোসাহেবীতে ব্যস্ত ছিল যে, ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন না হলে আর ক’বছরে দেশে সুন্নী কোন রাজনৈতিক দলও থাকতো না। সবাই ওলামালীগ (পড়ুন এলোমেলো লীগ) হয়ে যেত। বিপরীতে ভিন্ন আকিদার আলেমরা হুঁশের পাগল, তারা স্ব স্ব স্বার্থ রক্ষা করে নৌকা চালিয়েছিল।

ফাইল ফটো
এখনও বেশির ভাগ মানুষ যারা চেনে জানে তাদের নিকট সুন্নী দল মানে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মোমবাতি)। ২০০১ সাল পরবর্তী কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর হতে ফ্রন্টের এই ২৪ বছরের রাজনীতিতে (১৯৯০ সাল থেকে ২০০১ আহ্বায়ক কমিটি) একটি জাতীয় নির্বাচন ব্যতীত আর কোন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় নি। তাহলে ইসলামী ফ্রন্ট নির্বাচনে গিয়ে স্বৈরাচারকে কেন বৈধতা দিল? এটি অনেকের প্রশ্ন। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে একাত্ব হয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও ভোট বর্জন করেন। তখন আ-লীগপন্থীরা বলেছিল, ইসলামী ফ্রন্ট বিএনপি-জামাতের দালাল। ২০১৮ সালে বিএনপি-জামাতসহ (জামাত বিএনপির মার্কায় ভোট করেন) সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও অংশ নেয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ না নিলেও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টসহ সুন্নী অন্যান্য দল ইসলামিক ফ্রন্ট, সুপ্রিম পার্টি, জাকের পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, কওমীপন্থী ইসলামী ঐক্যজোট সহ নিবন্ধিত ৪৪ টি দলের ২৬টি দল অংশ নেয়। কিন্তু সর্বদোষ যেন ইসলামী ফ্রন্টের, তারা কেন নির্বাচনে অংশ নিল?ইসলামী ফ্রন্টের এত জনপ্রিয়তা যে, ইসলামী ফ্রন্টই নাকি আ-লীগের একতরফা নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। ২০১৪ সালে যে ইসলামী ফ্রন্টকে বিএনপির দালাল বলা হলো, তারা ২০২৪ সালে আ-লীগের দালাল হয়ে গেল। আর মধ্যখানে- ২০১৮ সালে নির্বাচনকারী সবাই বুজর্গ বন গিয়া। বর্তমানে ৫৩ টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র ৭টি দল অন্তবর্তী সরকারের সাথে সংলাপের ডাক পেয়েছে, ৪৬ টি দল সংলাপের ডাক পায় নি। আ-লীগ বা ১৪ দলের কথা বাদ দিলেও দেশে সাবেক এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অনেক দলও যে সংলাপের ডাক পায় নি, তাতে সমস্যা নাই। সব দোষ নিজের দলের নেতাদের কাঁধে তুলে দিলেন??

আমরা কিভাবে ভুলে যায় যে, যে কোন দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তা ভুলও হতে পারে, সঠিকও হতে পারে। আপনি ওই দলের কর্মী-সমর্থক হলে মানবেন বা পছন্দ না হলেও চুপ থাকবেন বা দলীয় ফোরামে পর্যালোচনা করবেন। প্রয়োজনে নিজ ফোরামে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে লিখিতভাবে যথাযথ মাধ্যমে দিয়ে জানাতে পারেন। অন্যথায় তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। ইসলামী ফ্রন্টের নীতিনির্ধারণী বোর্ডে যারা আছেন, তারা কেউ ফেরশতা নন, সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে ভুল-ত্রুটি ও অপরাধের উর্ধ্বে নন তারা। তাদের ভুল বা অপরাধ হলে তা যথা নিয়মে সংশোধন বা ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব। আপনারা কী কেউ দেখেছেন? একাত্তরে হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়ে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে যে দল অবস্থান নিয়েছিল, তাদের কোন নেতাকর্মীদের সে বিষয়ে অনলাইন-অফলাইন কোথাও টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে শুনেছেন কভু? না, শুনেন নি। এমনকি যে অটোপাশ মন্ত্রী-এমপিরা বিদেশে বেগমপাড়া করেছে, হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার করে দেশকে পঙ্গু করেছে, সেই দুর্নীতিবাজ নেতাদের কারণে আজ ওই দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। তারাও কী এভাবে কোথাও তাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে বা নীতিনির্ধারণী কমিটির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছে? করে নি। একসময়ের ১০% এর কথা Gen Z এর পূর্বসূরীরা জানেন, কখনও তাদের নেতাকর্মীদের এ ব্যাপারে সমালোচনা করতে দেখেছেন।




ফাইল ফটো – বা. ই. ফ্রন্টের সমাবেশ

ফাইল ফটো


ফাইল ফটো
যার প্রতি মানুষের আশা-প্রত্যাশা বেশি থাকে, তার সফলতায় মুগ্ধ ও আনন্দিত হয়ে প্রশংসা যেমন করে, তেমনিভাবে তার ব্যর্থতায় ব্যথিত হয়ে সমালোচনাও করে। ত্রুটি বর্ণনা করে। তাই প্রশংসাকে আপনি যেভাবে গ্রহণ করেন। ব্যর্থতায় সমালোচনাও সানন্দে গ্রহণে প্রস্তুত থাকতে হবে।
সমালোচনা ও অসহিষ্ণুতা এক বিষয় নয়। সংশোধনের জন্য সমালোচনা করা এবং হিংসা-ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে অযাচিত মন্তব্য করা এক হতে পারে না। প্রশংসার ক্ষেত্রে উদার এবং সমালোচনার আগে সচেতন হওয়াতে একজন জ্ঞানীর পরিচয় বহন করে।

ফাইল ফটো
প্রকৃতপক্ষে, আমরা নিজের বগলের গন্ধ না খোঁজে শুধু অপরের গন্ধ খোঁজতে মত্ত থাকি। আমাদের মাঝে এমন লোকও আছে যারা অপরের ছিদ্র অন্বেষণকে পেশা-নেশা করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছেন, “পরের দোষত্রুটি লইয়া কেবলই সমালোচনা করিতে থাকিলে মন ছোটো হইয়া যায়, স্বভাব সন্দিগ্ধ হইয়া উঠে, হৃদয়ের সরসতা থাকে না।”
‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ‘দ্য ভিউ ফ্রম দ্য টপ: পলিটিক্যাল লিডারশিপ ইন দ্য মডার্ন এজ’ শিরোনামের অধিবেশনে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরিস তাডিক বলেছিলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ। রাজনীতিবিদের ওপরে তাদের আকাঙ্ক্ষার চাপ সব সময় থাকবে। তারা বেশি করে রাজনীতির অংশ হতে চাইবে। তবে একজন রাজনীতিবিদের কাজ হওয়া উচিত রাজনীতিতে যাতে বেশি মানুষ অংশ নেয়, সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা। আর সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে থাকতে হবে। কারণ, তাঁদেরকে দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনা হবে। এটা সারা পৃথিবীতে আছে।
.
ধৈর্য ও সহ্য শক্তি না থাকলে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ নাই। আবেগ দিয়ে নেতৃত্ব হয় না। মুনাফিক-দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাজরা স্ব স্ব সুবিধা লাভের মানসে সাধারণ নেতাকর্মীদের আবেগকে ব্যবহার করে পরিকল্পিত বিশঙ্খলা করে সর্বস্তরে। এজন্য অসহিষ্ণু ও অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত দেওয়া নেতৃত্বের গুণের পরিপন্থী। কাউকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করা কোনভাবেই কাম্য নয়। সংগঠন চায়লে যে কাউকে নেতৃত্বে আনতে পারে, যে কাউকে বাদ দিতে পারে। কিন্তু, চারিত্রিক কালিমা লেপন করে সাংগঠনিক পদে রদবদল কখনও রাজনৈতিক বা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হতে পারে না। দুই বছর পূর্বের ঘটনা ও মিমাংসিত বিষয়ে অপতথ্য ছড়িয়ে শুধু সংগঠন করার অপরাধে সাংগঠনিক ঈমানী সেনানী ভাই নামধারীরা (পড়ুন মুনাফিকরা) একজন ভাইকে অপদস্ত করেছে, একইভাবে তদন্ত বা বিচার ব্যতীত যারা শাস্তি দিয়েছে, যদি সে সেই ভাইটি যদি অপরাধ না করেই থাকে রোজ কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের সামনে কী জবাব দেবেন ভেবে দেখুন।
.
আসুন, আগে নিজের সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা, অপরাগতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসংগতি সম্পর্কে জানি। নিজের পায়ে কুড়াল মেরে পা কেটেছে কেন? প্রতিবাদ করার আগে নিজেকে শোধরানো উচিত। নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক হই। নিজে বদলে গেলে সমাজ, দল, রাষ্ট্র সব বদলে যাবে। আল্লাহ পাক সূরা মায়িদার ২ নং আয়াতের শেষাংশে বলেছেন- اَنۡ تَعۡتَدُوۡا ۘ وَتَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَالتَّقۡوٰی ۪ وَلَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَالۡعُدۡوَانِ ۪ وَاتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ
আল্লাহপাক আমাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাআত এর উপর দায়েম-কায়েম থাকার তৌফিক দিন, আমিন।
#লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক,
অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।