সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:১০ পূর্বাহ্ন

তৃতীয় নয়নে দেখা ♦ সাম্প্রতিকী

প্রতিনিধির নাম
  • প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৩২১ বার পড়া হয়েছে
তৃতীয় নয়নে দেখা

তৃতীয় নয়নে দেখা ♦ সাম্প্রতিকী

–অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম

ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয় সফল ও বিজয়ীদের। পৃথিবীতে ব্যর্থ ও পরাজিতদের ইতিহাস থাকে না। চব্বিশের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের বর্তমানে বীর সম্ভোধন করছি। যদি আন্দোলনে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন না হতো, তবে আজকের বীরেরা নাশকতার মামলায় জেলে পুড়তো। আমরা যা ৫ আগস্টের পূর্বে ছাত্রদেরকে ব্লকরেইড দিয়ে গ্রেপ্তারের সময় দেখেছি। সুতরাং, বলা যায়- জয় বা পরাজয়ের ভিত্তিতে সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিহাস ভিন্ন ভাবে রচিত হয়।

তৃতীয় নয়নে দেখা

আমরা কথায় কথায় নেতৃত্বের ব্যর্থতার গল্প নিয়ে হাজির হই। তারা এটা করেনি, ওটা পারে নি, ওইটা ছাড়েনি। দালালি করেছে, কেউ চিনে না, সংলাপে সবাই যায়- স্বৈরাচারের দালালি করেছে তাই ডাকে না, টাকা দিয়ে বিক্রি হয়েছে, দল ধ্বংস করেছে, পদ ছাড়ছে না, ওনারা পারবে না, ব্লা.. ব্লা. ব্লা।

উপর্যুক্ত বিষয়ে আলোচনার পূর্বে একটি ঘটনার আলোকপাত করছি।২০২৩ সালের লাস্টের দিকে আমাদের কোর্ট চেম্বারে ওলামালীগের একজন কেন্দ্রীয় ও চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান নেতা এসেছিলেন। ছাত্রসেনার সাবেক সভাপতি জি.এম শাহাদত হোসাইন মানিক ভাই তার পরিচয় আমাকে বলার সাথে সাথে আমি বললাম, আস্তাগফিরুল্লাহ। ওই লোকের সাথে নূন্যতম সৌজন্যতা দেখাতে আমার ঘৃণা লাগছিল। ফলে আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। তখন আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে, আলেম ব্যক্তি ইসলামী যে কোন দল করবে, এটাই স্বাভাবিক। আলেম ব্যক্তি কখনও ইসলাম বিরোধী /ধর্ম নিরপেক্ষতা মতবাদ সমর্থন বা গ্রহণ বা লালন করতে পারেন না। দুঃখজনক হলেও নির্মম সত্য যে, বিগত ১২/১৪ বছরে সুন্নী আলেমরা শাসকগোষ্ঠির এত মোসাহেবীতে ব্যস্ত ছিল যে, ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন না হলে আর ক’বছরে দেশে সুন্নী কোন রাজনৈতিক দলও থাকতো না। সবাই ওলামালীগ (পড়ুন এলোমেলো লীগ) হয়ে যেত। বিপরীতে ভিন্ন আকিদার আলেমরা হুঁশের পাগল, তারা স্ব স্ব স্বার্থ রক্ষা করে নৌকা চালিয়েছিল।

ফাইল ফটো

এখনও বেশির ভাগ মানুষ যারা চেনে জানে তাদের নিকট সুন্নী দল মানে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মোমবাতি)। ২০০১ সাল পরবর্তী কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর হতে ফ্রন্টের এই ২৪ বছরের রাজনীতিতে (১৯৯০ সাল থেকে ২০০১ আহ্বায়ক কমিটি) একটি জাতীয় নির্বাচন ব্যতীত আর কোন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় নি। তাহলে ইসলামী ফ্রন্ট নির্বাচনে গিয়ে স্বৈরাচারকে কেন বৈধতা দিল? এটি অনেকের প্রশ্ন। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে একাত্ব হয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও ভোট বর্জন করেন। তখন আ-লীগপন্থীরা বলেছিল, ইসলামী ফ্রন্ট বিএনপি-জামাতের দালাল। ২০১৮ সালে বিএনপি-জামাতসহ (জামাত বিএনপির মার্কায় ভোট করেন) সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও অংশ নেয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ না নিলেও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টসহ সুন্নী অন্যান্য দল ইসলামিক ফ্রন্ট, সুপ্রিম পার্টি, জাকের পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, কওমীপন্থী ইসলামী ঐক্যজোট সহ নিবন্ধিত ৪৪ টি দলের ২৬টি দল অংশ নেয়। কিন্তু সর্বদোষ যেন ইসলামী ফ্রন্টের, তারা কেন নির্বাচনে অংশ নিল?ইসলামী ফ্রন্টের এত জনপ্রিয়তা যে, ইসলামী ফ্রন্টই নাকি আ-লীগের একতরফা নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। ২০১৪ সালে যে ইসলামী ফ্রন্টকে বিএনপির দালাল বলা হলো, তারা ২০২৪ সালে আ-লীগের দালাল হয়ে গেল। আর মধ্যখানে- ২০১৮ সালে নির্বাচনকারী সবাই বুজর্গ বন গিয়া। বর্তমানে ৫৩ টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র ৭টি দল অন্তবর্তী সরকারের সাথে সংলাপের ডাক পেয়েছে, ৪৬ টি দল সংলাপের ডাক পায় নি। আ-লীগ বা ১৪ দলের কথা বাদ দিলেও দেশে সাবেক এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অনেক দলও যে সংলাপের ডাক পায় নি, তাতে সমস্যা নাই। সব দোষ নিজের দলের নেতাদের কাঁধে তুলে দিলেন??

আমরা কিভাবে ভুলে যায় যে, যে কোন দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তা ভুলও হতে পারে, সঠিকও হতে পারে। আপনি ওই দলের কর্মী-সমর্থক হলে মানবেন বা পছন্দ না হলেও চুপ থাকবেন বা দলীয় ফোরামে পর্যালোচনা করবেন। প্রয়োজনে নিজ ফোরামে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে লিখিতভাবে যথাযথ মাধ্যমে দিয়ে জানাতে পারেন। অন্যথায় তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। ইসলামী ফ্রন্টের নীতিনির্ধারণী বোর্ডে যারা আছেন, তারা কেউ ফেরশতা নন, সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে ভুল-ত্রুটি ও অপরাধের উর্ধ্বে নন তারা। তাদের ভুল বা অপরাধ হলে তা যথা নিয়মে সংশোধন বা ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব। আপনারা কী কেউ দেখেছেন? একাত্তরে হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়ে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে যে দল অবস্থান নিয়েছিল, তাদের কোন নেতাকর্মীদের সে বিষয়ে অনলাইন-অফলাইন কোথাও টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে শুনেছেন কভু? না, শুনেন নি। এমনকি যে অটোপাশ মন্ত্রী-এমপিরা বিদেশে বেগমপাড়া করেছে, হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার করে দেশকে পঙ্গু করেছে, সেই দুর্নীতিবাজ নেতাদের কারণে আজ ওই দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। তারাও কী এভাবে কোথাও তাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে বা নীতিনির্ধারণী কমিটির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছে? করে নি। একসময়ের ১০% এর কথা Gen Z এর পূর্বসূরীরা জানেন, কখনও তাদের নেতাকর্মীদের এ ব্যাপারে সমালোচনা করতে দেখেছেন।

ছাত্রসেনার বিজয় মিছিল (ফাইল ফটো)

অথচ, আমার আপনার দল বা নেতারা এ ধরণের কোন অপরাধ করে নি। তাদের চেষ্টায় ভুল থাকতে পারে। বিগত নির্বাচনের সিদ্ধান্তে আমিও দ্বিমত ছিলাম, সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতার সুযোগ নাই। আর দল ত্যাগ করলে ভিন্ন কথা। কিন্তু দলের নেতাকর্মী-সমর্থক পরিচয়ে যে যেভাবে তাদের চরিত্রহনন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় উন্মুক্ত লেখালেখি ও পদত্যাগ দাবি করছেন। আর এতে দলের প্রতি আপনার অতি ভালোবাসায় দল কলঙ্কিত হচ্ছে, বরং নিজেদের ছোট করছেন; তা কী বিন্দু পরিমাণ চিন্তা করেছেন? যেখানে দলের সর্বোচ্চ নেতাদের উন্মুক্ত সমালোচনার মাধ্যমে নিজে দল ও নিজেকে নাঙ্গা করে দিচ্ছেন। ফলে ভবিষ্যতে আপনি কখনও এ দল বা প্রতীক নিয়ে জনসমক্ষে সর্মথন চায়তে পারবেন? পান থেকে চুন খসলেই যেভাবে আমরা গেল গেল রব তুলি। আপনি আমি আমরা কী নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি? অন্য কোন দলে এভাবে নেতৃত্বের চরিত্রহনন করে দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ আছে কিনা?


অথচ, আমরা পরস্পর ঈমানী সংগঠন ও ঈমানী ভাই দাবি করছি। রাসূল (দ.) বলেন, أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‏”
অর্থাৎ- জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোন ব্যাক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ.) কে বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে ভেবে দেখুন- আপনিও একটি স্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সে বিষয়ে আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন। তখন কী করবেন? নেতারা হক আদায় না করলে যেভাবে আল্লাহর দরবারে রেহাই পাবেন না, আপনিও আপনার উপর অর্পিত ও প্রদত্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হলে আল্লাহর দরবারে পাকড়াও হবেন। নেতার দোষে আপনার সাজা হবে না, আপনার দোষে আপনার সাজা হবে- এটি মুমিন হলে বিশ্বাস রাখতেই হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তা-ও সে দেখবে।’ সূরা জিলজাল ( ৭ ও ৮ নং আয়াত)

ফাইল ফটো – বা. ই. ফ্রন্টের সমাবেশ

সমাজে ও রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক অসম্মানের একটি যোগসূত্র আছে। অন্যকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দের কারণে ভুল হোক শুদ্ধ হোক অপছন্দনীয় ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে হেয় করে, অবদানকে অস্বীকার করে, বেঈমান-মুনাফিকের মত ঈমানী ভাইয়ের ইজ্জতকে নিলাম করে আমরা চরম বিকৃত আনন্দ পায়। অথচ আমরা কিন্তু সহজেই একে অন্যকে সম্মান করতে পারি। এই যে আমরা কথায় কথায় ৪৩ বছরের কথা বলি নেতৃত্বের সমালোচনা করি। এই ৪৩ বছর পূর্বে কী এদেশে সুন্নীয়ত ছিল না? প্রায় ১৩০০ বছর পূর্বে এ দেশে ইসলাম এসেছে। ইসলাম প্রচার করেছেন আল্লাহর অলিগণ। আর আউলিয়া কেরামগণ সবাই সুন্নী। সময়ের প্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সুন্নীদের কোন প্লাটফর্ম ছিল না। যাদেরকে অযোগ্য, ব্যর্থ প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করছি, তারাই কিন্তু আজকে আপনাকে ৪০/৪৩ বছর ইত্যাদি বলে অভিযোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন আমাদের Gen Z প্রজন্ম (১৯৯৭-বর্তমান) আপনারা যারা আছেন, তারা ২০০১-২০০৫ সালে ছোট ছিলেন বিধায় শুধু আপনাদের চোখে সদ্য গজিয়ে ওঠা স্বৈরাচারকে দেখেছেন মাত্র। আপনাদের বিশেষতঃ সুন্নী ছাত্রজনতাকে বাংলাদেশের ১৯৭১সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সকল ইতিহাস বিশেষত: রাজনৈতিক বিষয়ে পড়তে ও জানতে হবে। একইভাবে ধর্মীয় বিষয়ে ও আকাবিরে আহলে সুন্নাহর মৌলিক আদর্শ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। তখন সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। তখন আপনার পূর্ববর্তী প্রজন্ম ও নেতৃত্ব কত স্ট্রাগল করে এ সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন, তাদের সেই ত্যাগ তিতিক্ষা সম্পর্কে যখন জানবেন, তখন ওয়ার্ড-ইউনিট, থানা-জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মী হয়ে হুট করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করতে দশ বার ভাবতেন। সিনিয়র-জুনিয়র মান্য না করে ফেসবুকে সুযোগ আছে বিধায় কমেন্ট বক্স যা-তা মন্তব্য করা আদবের পরিপন্থী। আমিও অনেক বিষয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত, কিন্তু উন্মুক্ত প্লাটফর্মে নেতৃত্ব সম্পর্কে উন্মুক্তভাবে বিব্রতকর কোন মন্তব্য করতে সংকোচ বোধ করি।

ফাইল ফটো

তাহলে আপনি বলবেন, আমরা কী নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারব না? হ্যাঁ, অবশ্যই পারব। ইসলামী সংগঠনে নেতাকে সরাসরি প্রশ্ন করার রাইট আছে। যেমন- হযরত ওমর (রা.)কে করেছিল। যারা বর্তমান পরিকল্পিত ও চক্রবদ্ধ হয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলছেন, আবার অনেকে বাস্তবতা না বুঝে অন্যের দেখাদেখি গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছেন, তারা কিন্তু অধিকাংশ চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের। তাই ফেবুতে না লিখে সরাসরি নেতৃত্বকে প্রশ্ন করুন। অযথা, গীবত ও বোহতানের অপরাধে আল্লাহর দরবারে অপরাধী হবেন কেন??

প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, এমনকি নিজ দলের মধ্যে বিরাগভাজন হওয়া নেতাকর্মীরা সব জায়গা থেকে সব সময় রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে তাঁদের (নেতৃত্বের) বিরুদ্ধে অপতথ্য ছড়ানো হয়। সহিংসতার পাশাপাশি জেল ও নির্যাতনের শিকারও তাঁদের হতে হয়। তবে দিন শেষে রাজনীতি একটি দেশের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই একজন রাজনীতিবিদের সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

ফাইল ফটো

শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নিম্নোক্ত উক্তিটি হয় তো শুনেছেন, তিনি বলেন ” আপনি যদি কোন ভালো কাজ করেন তাহলে লোকে আপনার সমালোচনা করবেই। আম গাছে আম ধরে বলেই লোকে ঢিল ছোঁড়ে। ফজলি আম গাছে আরও বেশি ঢিল ছোঁড়ে। শেওড়া গাছে কেউ ভুলেও ঢিল ছোঁড়ে না।”

যার প্রতি মানুষের আশা-প্রত্যাশা বেশি থাকে, তার সফলতায় মুগ্ধ ও আনন্দিত হয়ে প্রশংসা যেমন করে, তেমনিভাবে তার ব্যর্থতায় ব্যথিত হয়ে সমালোচনাও করে। ত্রুটি বর্ণনা করে। তাই প্রশংসাকে আপনি যেভাবে গ্রহণ করেন। ব্যর্থতায় সমালোচনাও সানন্দে গ্রহণে প্রস্তুত থাকতে হবে।

সমালোচনা ও অসহিষ্ণুতা এক বিষয় নয়। সংশোধনের জন্য সমালোচনা করা এবং হিংসা-ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে অযাচিত মন্তব্য করা এক হতে পারে না। প্রশংসার ক্ষেত্রে উদার এবং সমালোচনার আগে সচেতন হওয়াতে একজন জ্ঞানীর পরিচয় বহন করে।

ফাইল ফটো

প্রকৃতপক্ষে, আমরা নিজের বগলের গন্ধ না খোঁজে শুধু অপরের গন্ধ খোঁজতে মত্ত থাকি। আমাদের মাঝে এমন লোকও আছে যারা অপরের ছিদ্র অন্বেষণকে পেশা-নেশা করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছেন, “পরের দোষত্রুটি লইয়া কেবলই সমালোচনা করিতে থাকিলে মন ছোটো হইয়া যায়, স্বভাব সন্দিগ্ধ হইয়া উঠে, হৃদয়ের সরসতা থাকে না।”

বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ‘দ্য ভিউ ফ্রম দ্য টপ: পলিটিক্যাল লিডারশিপ ইন দ্য মডার্ন এজ’ শিরোনামের অধিবেশনে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরিস তাডিক বলেছিলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ। রাজনীতিবিদের ওপরে তাদের আকাঙ্ক্ষার চাপ সব সময় থাকবে। তারা বেশি করে রাজনীতির অংশ হতে চাইবে। তবে একজন রাজনীতিবিদের কাজ হওয়া উচিত রাজনীতিতে যাতে বেশি মানুষ অংশ নেয়, সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা। আর সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে থাকতে হবে। কারণ, তাঁদেরকে দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনা হবে। এটা সারা পৃথিবীতে আছে।
.
ধৈর্য ও সহ্য শক্তি না থাকলে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ নাই। আবেগ দিয়ে নেতৃত্ব হয় না। মুনাফিক-দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাজরা স্ব স্ব সুবিধা লাভের মানসে সাধারণ নেতাকর্মীদের আবেগকে ব্যবহার করে পরিকল্পিত বিশঙ্খলা করে সর্বস্তরে। এজন্য অসহিষ্ণু ও অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত দেওয়া নেতৃত্বের গুণের পরিপন্থী। কাউকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করা কোনভাবেই কাম্য নয়। সংগঠন চায়লে যে কাউকে নেতৃত্বে আনতে পারে, যে কাউকে বাদ দিতে পারে। কিন্তু, চারিত্রিক কালিমা লেপন করে সাংগঠনিক পদে রদবদল কখনও রাজনৈতিক বা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হতে পারে না। দুই বছর পূর্বের ঘটনা ও মিমাংসিত বিষয়ে অপতথ্য ছড়িয়ে শুধু সংগঠন করার অপরাধে সাংগঠনিক ঈমানী সেনানী ভাই নামধারীরা (পড়ুন মুনাফিকরা) একজন ভাইকে অপদস্ত করেছে, একইভাবে তদন্ত বা বিচার ব্যতীত যারা শাস্তি দিয়েছে, যদি সে সেই ভাইটি যদি অপরাধ না করেই থাকে রোজ কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের সামনে কী জবাব দেবেন ভেবে দেখুন।
.
আসুন, আগে নিজের সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা, অপরাগতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসংগতি সম্পর্কে জানি। নিজের পায়ে কুড়াল মেরে পা কেটেছে কেন? প্রতিবাদ করার আগে নিজেকে শোধরানো উচিত। নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক হই। নিজে বদলে গেলে সমাজ, দল, রাষ্ট্র সব বদলে যাবে। আল্লাহ পাক সূরা মায়িদার ২ নং আয়াতের শেষাংশে বলেছেন- اَنۡ تَعۡتَدُوۡا ۘ وَتَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَالتَّقۡوٰی ۪ وَلَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَالۡعُدۡوَانِ ۪ وَاتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ

আল্লাহপাক আমাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাআত এর উপর দায়েম-কায়েম থাকার তৌফিক দিন, আমিন।

#লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক,
অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।

Please Share This Post in Your Social Media

এ বিভাগের আরো সংবাদ