সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন

কোরবানির পশু যৌতুক: ধর্মীয় আবরণে সামাজিক ব্যাধি

প্রতিনিধির নাম
  • প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ৬ জুন, ২০২৫
  • ১৫৩ বার পড়া হয়েছে
কোরবানির পশু যৌতুক: ধর্মীয় আবরণে সামাজিক ব্যাধি

অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম

কোরবানির পশু যৌতুক: ধর্মীয় আবরণে সামাজিক ব্যাধি

বাংলাদেশে ঈদুল আযহা মুসলিম সমাজের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। কোরবানি একটি পবিত্র ইবাদত, যা তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই পবিত্র ধর্মীয় অনুশীলনের নাম ব্যবহার করে সমাজে এক অশুভ প্রবণতা দেখা দিয়েছে–’কোরবানির পশু যৌতুক’। এটি কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং ইসলামি শিক্ষার বিকৃতি এবং নারীর প্রতি বৈষম্যের এক জঘন্য উদাহরণ। এই প্রবন্ধে কোরবানির পশু যৌতুকের বাস্তবতা, ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক প্রভাব এবং সমাধানের পথ বিশ্লেষণ করা হবে, পরিসংখ্যান ও প্রামাণ্য উৎসসহ।

যৌতুক: বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা একটি গভীর সামাজিক সমস্যা। সরকারি ও বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে, যৌতুকের কারণে নারীরা প্রতিনিয়ত শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০২২ সালেই দেশে ৬৯২টি যৌতুক-সংক্রান্ত নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ১৮৯টি ছিল প্রাণঘাতী। BRAC-এর একটি ২০২১ সালের গবেষণায় বলা হয়, বিয়ের সময় ৭৮% ক্ষেত্রে কনের পরিবার যৌতুক দিতে বাধ্য হয়, যার মধ্যে ঈদের সময় পশু কেনার চাপ অন্যতম উল্লেখযোগ্য। এই চাপে অনেক পরিবার ঈদুল আযহার সময় ছেলের পরিবারকে কোরবানির গরু উপহার দিতে বাধ্য হয়, যা এখন যৌতুকের একটি “নতুন সংস্করণ” হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ: কোরবানি ও যৌতুক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- কোরবানি: একটি তাকওয়াভিত্তিক ইবাদত। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আল্লাহর কাছে পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”— (সুরা হজ্ব, আয়াত ৩৭)। এখানে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, কোরবানি একটি নফল ইবাদত যা একান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এটি কারো পক্ষ থেকে জোর করে আদায় করার বা সামাজিক সম্মান রক্ষার ইবাদত নয়।
যৌতুক: ইসলামে স্পষ্ট নিষিদ্ধ যৌতুক। নবী করিম (দ.) এর কোনো স্ত্রীকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে করা হয়নি, বরং তিনি মহর প্রদান করেছেন। হাদিসে এসেছে: “তোমাদের মধ্যে সেই বিয়ে সর্বোত্তম, যাতে খরচ কম হয়।”—(ইবনে হিব্বান)।

কোরবানির পশু যৌতুক: ধর্মীয় আবরণে সামাজিক ব্যাধি

কোরবানির পশু যৌতুক: বর্তমানে নতুন সামাজিক বিপদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। যেমন-
১. আর্থিক চাপ ও দারিদ্র্যের ফাঁদ: অনেক দরিদ্র পরিবার সম্মান রক্ষার জন্য ঈদুল আযহা ঘিরে গরু কিনে যৌতুক হিসেবে দিয়ে থাকেন। এতে তাদের ঋণগ্রস্ত হতে হয়। একাধিক এনজিওর রিপোর্ট অনুযায়ী, কোরবানির সময় যৌতুক দিতে গিয়ে প্রায় ২১% নিম্নবিত্ত পরিবার স্থানীয় ঋণদানকারীদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয়। — (সূত্র: Action Aid Bangladesh, 2022)
২. নারী নির্যাতনের নতুন রূপ: যৌতুক হিসেবে কোরবানির পশু না দিতে পারলে অনেক পরিবার মেয়েকে ঈদের পর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের হাতে অপমান, নির্যাতন ও তালাকের হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আইন সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, কোরবানির ঈদকে ঘিরে যৌতুক-সংক্রান্ত নারীর প্রতি সহিংসতার হার ঈদের মাসে প্রায় ১২% বৃদ্ধি পায়।
৩. ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও সামাজিক চাপ: কিছু পরিবার মনে করে, কোরবানি না দিলে “সমাজে মুখ দেখানো যাবে না”। এই মনোভাব ছেলে পক্ষের মাঝে জন্ম দেয় পশু চাওয়ার দাবী– যা ইবাদতকে পণ্য বানিয়ে ফেলে।

কোরবানির পশু যৌতুকের বাস্তব উদাহরণ – ১. রাজশাহীতে ২০২২ সালে এক গৃহবধূর ওপর স্বামী ও শাশুড়ি গরু না আনতে পারার কারণে নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। ২. বরিশালে ২০২১ সালের একটি ঘটনায়, গরু না দেওয়ায় কনে পক্ষের পরিবারের বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য করে বিবাহ বিচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা স্থানীয় সংবাদপত্র ও আইন সহায়তা সংস্থাগুলোর রিপোর্টে নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে।

এক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে-  ১. ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার: – মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামিক সেমিনারে যৌতুক ও কোরবানির প্রকৃত ব্যাখ্যা দিতে হবে। – কোরবানি পবিত্র ইবাদত -এই শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে।
২. আইনি প্রয়োগ শক্তিশালী করা: – যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুযায়ী যৌতুক গ্রহণ ও দাবির ক্ষেত্রে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যদিও এ আইনের অপব্যবহারও লক্ষণীয়। – কোরবানির পশু যৌতুক হিসেবে চাওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত।
৩. গণমাধ্যম ও শিক্ষার ভূমিকা: – নাটক, চলচ্চিত্র, বই ও গণমাধ্যমে যৌতুকবিরোধী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। – স্কুল-কলেজ পর্যায়ে যৌতুকবিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৪. সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা: – বেসরকারি সংস্থা ও তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে সামাজিকভাবে এই অপচর্চার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।

পরিশেষে প্রতীয়মান হয় যে,’কোরবানির পশু যৌতুক’ কেবল একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এটি ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নামান্তর। সমাজে নারীকে নিচু করে দেখা, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা এবং অপসংস্কৃতি চর্চা এই সমস্যাকে দিনদিন বাড়িয়ে তুলছে।
এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো – সচেতনতা বৃদ্ধি, আইন প্রয়োগ, এবং ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে এই অন্যায় রীতির অবসান ঘটানো। কোরবানি যেন আত্মত্যাগ ও তাকওয়ার প্রতীক হয়ে থাকে, আর কখনোই কারো জন্য লাঞ্ছনা, চাপ কিংবা অন্যায় দাবির অস্ত্র না হয়– ধর্মীয় আবরণে সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে এই হোক আমাদের মূল বার্তা।

তথ্যসূত্র :
১. Bangladesh Mahila Parishad Annual Report 2023
২. BRAC Gender Justice & Diversity Program Survey, 2021
৩. Ain o Salish Kendra (ASK) Quarterly Report, July–September 2023
৪. Action Aid Bangladesh: “Debt and Dowry – A Silent Crisis”, 2022
৫. The Holy Qur’an – Surah Al-Hajj: Ayah 37
৬. Ibn Hibban, Hadith Collection on Marriage
৭. জাতীয়-স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।
অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম ও
সদস্য সচিব, বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স ফ্রন্ট,
চট্টগ্রাম জেলা বার ইউনিট।

E-mail- adv.faridulislam1990@gmail.com
মোবাইল নং- 01645295051

Please Share This Post in Your Social Media

এ বিভাগের আরো সংবাদ